বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO-এর নির্দেশনা অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি বা ফিজিক্যাল থেরাপি হলো এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা যা সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক স্বতন্ত্রভাবে রোগীর রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসাব্যবস্থা প্রদান করতে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপি (ডব্লিউসিপিটি)-এর মতে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক প্রফেশনাল ডিগ্রিধারীরাই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক বা ফিজিওথেরাপিস্ট এবং স্বাধীনভাবে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারেন।
ফিজিওথেরাপি
ফিজিও (শারীরিক) এবং থেরাপি (চিকিৎসা) শব্দ দুটি মিলে ফিজিওথেরাপি বা শারীরিক চিকিৎসা। ফিজিওথেরাপি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অন্যতম এবং একটি অপরিহার্য শাখা। শুধু ওষুধ সব রোগের পরিপূর্ণ সুস্থতা দিতে পারে না। বিশেষ করে বিভিন্ন মেকানিক্যাল সমস্যা থেকে যে সব রোগের সৃষ্টি হয়, তার পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভের উপায় ফিজিওথেরাপি।
ফিজিওথেরাপি হলো একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর সব কথা শুনে-বুঝে, রোগীকে ভালোভাবে দেখে এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর সঠিক রোগ, আঘাত বা অঙ্গ বিকৃতির ধরন নির্ণয় করে রোগীকে বিভিন্ন ধরনের ফিজিক্যাল মেথড যেমন ম্যানুয়াল টেকনিক, তাপ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে চিকিৎসা করে থাকেন।
সড়ক দুর্ঘটনা, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, বিকলাঙ্গতা, পক্ষাঘাত ও বড় কোনো অস্ত্রোপচারের পর রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের বাত, মাথা, ঘাড়, কাঁধ, পিঠ, কোমর ও হাঁটুর ব্যথায় এবং স্পোর্টস ইনজুরিতে ফিজিওথেরাপি বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত চিকিৎসাব্যবস্থা।
ফিজিওথেরাপি’র সূচনা ও বাংলাদেশে এর ব্যাপ্তি
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সাম্প্রতিক কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নয়। হিপোক্রেটাস সেই প্রাচীন গ্রিসে ম্যাসেজ ও ম্যানুয়াল থেরাপি দ্বারা ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার পরিচয় করিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ সালে হেক্টর ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার একটি শাখা ব্যবহার করতেন যাকে বর্তমানে হাইড্রোথেরাপি বলা হয়। যতটুকু জানা যায়, ১৮৯৪ সালে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার বর্তমান ধারা অর্থাৎ ম্যানুয়াল থেরাপি, ম্যানিপুলেটিভ থেরাপি, এক্সারসাইজ থেরাপি, হাইড্রোথেরাপি, ইলেক্ট্রোথেরাপি ইত্যাদি প্রবর্তন করা হয়। নিউজিল্যান্ডে ১৯১৩ এবং আমেরিকাতে ১৯১৪ সালে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা শুরু হয়।
বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপির যাত্রা অনেকদিন পরে। বিশদভাবে ও একাডেমিকভাবে ১৯৭২ সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য বিদেশি ফিজিওথেরাপিস্ট দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার সূচনা হয়। এর পরে ফিজিওথেরাপির ব্যবহার এ দেশে উত্তর উত্তর বাড়তেই থাকে। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা অনুষদের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি চালু করা হয়। বর্তমানে নিটোর, সিআরপি, পিপলস্ ইউনিভার্সিটি, গণবিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট কলেজ অব হেলথ সায়েন্সসহ বেশ কয়েকটি ইন্সটিটিউটে ফিজিওথেরাপি গ্রাজুয়েশন কোর্স চালু রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এবং স্বতন্ত্র কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা না থাকায় শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পায় না এবং অপচিকিৎসার শিকার হন।
ফিজিওথেরাপির প্রয়োজনীয়তা
আমরা যত আধুনিক প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে চলছি তত বেশি পরিমাণ স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছি। দেখা গেছে শরীরের বিভিন্ন রোগ শুধু ওষুধ দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে যে সব রোগের উৎস বিভিন্ন মেকানিক্যাল সমস্যা, সেসব ক্ষেত্রে ওষুধের ভূমিকা তুলনামূলকভাবে কম। যেমন- বাত, কোমর ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, হাঁটু ব্যথা, আঘাতজনিত ব্যথা, হাড় ক্ষয়জনিত রোগ, জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া, স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, মুখ বেঁকে যাওয়া, সেরিব্রাল পালসি, স্পোর্টস ইনজুরি ইত্যাদি।
তাহলে এসব রোগ থেকে পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভের উপায় কী? এ ক্ষেত্রেই চলে আসে ফিজিওথেরাপির কথা। ফিজিওথেরাপি এই সব রোগ থেকে মানুষকে পুরোপুরি মুক্তি না দিতে পারলেও উপশম করে ও উন্নতি হয়।