স্ট্রোক/স্ট্রোক কি?
স্ট্রোক কি স্ট্রোক হল মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহের ব্যাঘাত, যা সাধারণত মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে বাধা পড়লে বা কোনো রক্তনালী ফেটে গেলে ঘটে। মস্তিষ্ক স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন এবং পুষ্টি পায়, কিন্তু স্ট্রোক হলে সেই টিস্যু গুলো রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই কোষ গুলোর মৃত্যু হতে শুরু করে।
Table of Contents
স্ট্রোক কত প্রকারঃ
ইস্কেমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke): আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের একটি গবেষনায় দেখা গেছে বর্তমানে প্রায় ৮৭% রোগীর ইস্কেমিক স্ট্রোক
হয়। ইস্কেমিক স্ট্রোক তখন ঘটে যখন মস্তিষ্কের রক্তনালী তে রক্তের জমাট বাঁধা বা চর্বির প্ল্যাক জমে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। রক্তনালী তে এই বাধা সৃষ্টি হলে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ পর্যাপ্ত অক্সিজেন এবং পুষ্টি পায় না, যার ফলে কোষের ক্ষতি হয়।
হেমোরেজিক স্ট্রোক (Hemorrhagic Stroke): WHO এর একটি গবেষনায় দেখা গেছে বর্তমানে প্রায় ১৩% রোগীর হেমোরেজিক স্ট্রোক হয় । এই ধরনের স্ট্রোক ঘটে যখন মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালী ফেটে গিয়ে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে বা আশেপাশে রক্তপাত হয়। উচ্চ রক্তচাপ, অ্যানিউরিজম (রক্তনালীর অস্বাভাবিক স্ফীতি), বা মস্তিষ্কে আঘাতের কারণে এটি হতে পারে।
ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক (Transient Ischemic Attack – TIA): আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশানের একটি গবেষনায় দেখা গেছে বর্তমানে প্রায় ১০-১৫% রোগীর ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক হয় । এটি একটি ক্ষণস্থায়ী স্ট্রোক বা “মিনি-স্ট্রোক” হিসেবে পরিচিত, যা মস্তিষ্কে অস্থায়ী ভাবে রক্ত প্রবাহ বাধা গ্রস্ত হলে ঘটে। TIA এর লক্ষণ গুলি স্ট্রোকের মতোই হতে পারে, তবে সেগুলি কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেড়ে যায় এবং কোনো স্থায়ী ক্ষতি হয় না। তবে TIA একটি বড় ধরনের স্ট্রোকের পূর্বাভাস হতে পারে, তাই এটি উপেক্ষা করা উচিত নয় এবং তক্ষণাৎ চিকিৎসকের সরনাপন্ন হওয়া উচিত।
স্ট্রোক কেন হয়ঃ
ইস্কেমিক স্ট্রোক তখনই ঘটে যখন মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালীতে রক্তের জমাট (থ্রম্বোসিস) বা জমাট বাঁধা রক্ত থেকে আলাদা হওয়া কোনো অংশ (এম্বোলিজম) মস্তিষ্কের ছোট ছোট রক্তনালীতে আটকে যায়। উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, এবং আলস্য জীবন তুলণামূলক ভাবে ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় ।
হেমোরেজিক স্ট্রোক ঘটে যখন মস্তিষ্কের রক্তনালী ফেটে যায় এবং মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণ হয়। এই ধরনের স্ট্রোকের কারণ হতে পারে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তনালীর অস্বাভাবিকতা (যেমন অ্যানিউরিজম বা আর্টারিওভেনাস ম্যালফরমেশন), রক্ত জমাট বাঁধা জনিত সমস্যা, অথবা মাথায় আঘাত লাগা। অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন, ধূমপান, এবং কিছু ধরনের ওষুধের অপব্যবহারও হেমোরেজিক স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে ।
ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক TIA এর প্রধান কারণ গুলোর মধ্যে রয়েছে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে জমাট বাঁধা রক্ত কণা (থ্রম্বোসিস) বা ছোট ছোট রক্ত জমাট (এম্বোলাস) আটকে যাওয়া, যা অস্থায়ী ভাবে রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এছাড়াও, অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস বা রক্তনালীর দেয়ালে চর্বি জমে রক্তনালী সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ (যেমন অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন), এবং উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল TIA এর ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন, অতিরিক্ত ওজন, এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তাও এই ঝুঁকির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বয়স বৃদ্ধি এবং পারিবারিক ইতিহাস TIA হওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে
স্ট্রোকের পূর্ব লক্ষণ/ স্ট্রোকের লক্ষণ
স্ট্রোকের পূর্ব লক্ষণ গুলো কে দ্রুত শনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে মস্তিষ্কের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। স্ট্রোকের কিছু সাধারণ পূর্ব লক্ষণ বা
সতর্কতা মূলক সংকেত নিম্নরূপ:
মুখ, হাত বা পায়ে হঠাৎ দুর্বলতা বা অবশ অনুভূতি: সাধারণত শরীরের একপাশে বেশি দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে মুখের এক পাশের পেশী ঢিলে বা দুর্বল হয়ে যেতে পারে, যার ফলে হাসার সময় মুখের এক পাশ নেমে যায়। একই ভাবে হাত বা পায়ের শক্তি কমে যেতে পারে, এমনকি কোনো কিছু ধরতে বা ধরে রাখতে অসুবিধা হতে পারে।
বিভ্রান্তি বা কথা বলায় সমস্যা: স্ট্রোক হলে মস্তিষ্কের ভাষা নিয়ন্ত্রণকারী অংশে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ব্যক্তি কথা বলার সময় উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পেতে অসুবিধা বোধ করেন বা স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে পারেন না। অনেক সময় তারা অন্যের কথা বুঝতেও অসুবিধায় পড়েন এবং বিভ্রান্তি অনুভব করেন। কারো কারো ক্ষেত্রে একেবারেই কথা বলতে না পারার মতো পরিস্থিতি হতে পারে, যা স্ট্রোকের স্পষ্ট সংকেত।
দৃষ্টি শক্তির পরিবর্তন: স্ট্রোকের কারণে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, যা কিনা দৃষ্টিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে, ফলে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, যে কোন কিছু দুটো দেখার অনুভূতি, বা সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই পরিবর্তন আকস্মিক হওয়ায় ব্যক্তি তাৎক্ষণিক ভাবে দৈনন্দিন কাজকর্মে অসুবিধা অনুভব করতে পারেন এবং এটি বেশ ভীতিকরও হতে পারে
স্ট্রোক কিঃ
হঠাৎ ভারসাম্যহীনতা বা মাথা ঘোরা: স্ট্রোক রোগীদের চলাফেরা করতে সমস্যা হয়, হঠাৎ ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় বা মাথা ঘুড়ে যা আচমকা ঘটে এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমে বড্ড বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে এই লক্ষণটি দেখা দিতে পারে, যা কিনা আমাদের চলাফেরা এবং ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে। স্ট্রোক হলে মস্তিষ্কের সমন্বয় ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে ব্যক্তি হঠাৎ করে চলাফেরায় অস্বস্তি অনুভব করেন এবং সঠিক ভাবে দাঁড়াতে বা বসতে পারেন না। অনেক সময় মাথা ঘোরার পাশাপাশি বমি বমি ভাবও হতে পারে।
হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা: বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা হতে পারে, যা আচমকা ঘটে এবং প্রায়ই অসহনীয় হতে পারে। এই মাথাব্যথা সাধারণ প্রকৃতির মাথাব্যথা থেকে আলাদা, কারণ এটি খুব দ্রুত এবং প্রচণ্ড আকারে শুরু হয়। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে বিশেষ করে হেমোরেজিক স্ট্রোকে, যখন মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালী ফেটে যায়, তখন এই ধরনের ব্যথা দেখা দিতে পারে। অনেক সময় এই ব্যথার সঙ্গে বমি ভাব, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা বা অস্থিরতাও অনুভূত হতে পারে।
এই লক্ষণ গুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া জরুরী। স্ট্রোকের লক্ষণ দ্রুত শনাক্ত করতে
BE FAST (Balance, Eyes , Face, Arms, Speech, Time) নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে।
- B-Balance : শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রনে আছে কি না ।
- E-Eyes : চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে কি না ।
- F-Face: মুখের এক পাশ নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে কি না।
- A-Arms: উভয় হাত তুলতে অসুবিধা হচ্ছে কি না।
- S-Speech: কথা অস্পষ্ট হচ্ছে কি না।
- T-Time: এই লক্ষণ গুলো দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
স্ট্রোক এর চিকিৎসা
স্ট্রোকের চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাৎক্ষণিক চিকিৎসা মস্তিষ্কের ক্ষতি হ্রাসে সহায়তা করে। স্ট্রোকের ধরন এবং কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা ভিন্ন ভিন্ন হয়। সাধারণত স্ট্রোকের দুই ধরনের চিকিৎসা রয়েছে: ইস্কেমিক স্ট্রোক এবং হেমোরেজিক স্ট্রোকের চিকিৎসা।
ইস্কেমিক স্ট্রোকের চিকিৎসা: ইস্কেমিক স্ট্রোক সাধারণত রক্তনালীতে ব্লকের কারণে ঘটে, যা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। এই ধরনের স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধা দূর করার জন্য থ্রম্বোলাইটিক ওষুধ দেওয়া হয়। আল্ট্রা-ফাস্ট ট্রিটমেন্টে টিস্যু প্লাজমিনোজেন অ্যাক্টিভেটর (TPA) নামক ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যা জমাট বাঁধা রক্ত দ্রুত দ্রবীভূত করে। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে মেকানিকাল থ্রম্বেকটমি করা হয়, যেখানে বিশেষ ক্যাথেটারের মাধ্যমে জমাট রক্ত সরিয়ে ফেলা হয়। দ্রুত এই চিকিৎসা শুরু করলে স্ট্রোকের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।
হেমোরেজিক স্ট্রোকের চিকিৎসা: এই ধরনের স্ট্রোক রক্তনালী ফেটে যাওয়ার কারণে ঘটে, যা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে। এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং রক্তক্ষরণ কমাতে ওষুধ দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে, যেখানে ফেটে যাওয়া রক্তনালী মেরামত বা বন্ধ করা হয়। এছাড়া মস্তিষ্কের ভিতরে জমে থাকা রক্ত সরানোর জন্য ক্লিপিং বা কয়েলিং নামক বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
ফিজিওথেরাপি: স্ট্রোকের পর ফিজিওথেরাপি আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক এবং মানসিক পুনর্বাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্ট্রোকের ফলে অনেক সময় শরীরের একপাশ দুর্বল বা অবশ হয়ে যায়, চলাফেরা এবং দৈনন্দিন কাজ করতে সমস্যা হয়। ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে ধীরে ধীরে পেশির শক্তি, ভারসাম্য এবং সমন্বয় ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়। একজন মানুষ স্ট্রোক করার ১০-১৫ দিন পর থেকেই একজন গ্র্যাজুয়েট ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পুর্ণাঙ্গ অ্যাসেসমেণ্টের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা শুরু করা খুবই জরুরী যা রোগীকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করে
তথ্যসূত্র
- Jauch, E.C., Saver, J.L., Adams Jr, H.P., Bruno, A., Connors, J.J., Demaerschalk, B.M., Khatri, P., McMullan Jr, P.W., Qureshi, A.I., Rosenfield, K. and Scott, P.A., 2013. Guidelines for the early management of patients with acute ischemic stroke: a guideline for healthcare professionals from the American Heart Association/American Stroke Association. Stroke, 44(3), pp.870-947. https://www.ahajournals.org/doi/abs/10.1161/str.0b013e318284056a
- Grysiewicz, R.A., Thomas, K. and Pandey, D.K., 2008. Epidemiology of ischemic and hemorrhagic stroke: incidence, prevalence, mortality, and risk factors. Neurologic clinics, 26(4), pp.871-895. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0733861908001047
- Furie, K.L., Kasner, S.E., Adams, R.J., Albers, G.W., Bush, R.L., Fagan, S.C., Halperin, J.L., Johnston, S.C., Katzan, I., Kernan, W.N. and Mitchell, P.H., 2011. Guidelines for the prevention of stroke in patients with stroke or transient ischemic attack: a guideline for healthcare professionals from the American Heart Association/American Stroke Association. Stroke, 42(1), pp.227-276. https://www.ahajournals.org/doi/abs/10.1161/str.0b013e3181f7d043
- Jauch, E.C., Saver, J.L., Adams Jr, H.P., Bruno, A., Connors, J.J., Demaerschalk, B.M., Khatri, P., McMullan Jr, P.W., Qureshi, A.I., Rosenfield, K. and Scott, P.A., 2013. Guidelines for the early management of patients with acute ischemic stroke: a guideline for healthcare professionals from the American Heart Association/American Stroke Association. Stroke, 44(3), pp.870-947. https://www.ahajournals.org/doi/abs/10.1161/str.0b013e318284056a
- Runchey, S. and McGee, S., 2010. Does this patient have a hemorrhagic stroke?: clinical findings distinguishing hemorrhagic stroke from ischemic stroke. Jama, 303(22), pp.2280-2286. https://jamanetwork.com/journals/jama/article-abstract/186042
- Broderick, J.P., Jauch, E.C. and Derdeyn, C.P., 2014. American Stroke Association Stroke Council Update.Stroke, 45(1), pp.e5-e7. https://www.ahajournals.org/doi/abs/10.1161/strokeaha.113.001357